উচ্চফলনশীল বিনা সয়াবিন৭ ও সয়াবিন চাষাবাদ পদ্ধতি
ড. মো. আব্দুল মালেক
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পূর্বশর্ত হলো খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন। খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও দৈনিক খাদ্য চাহিদার বিবেচনায় বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ পুষ্টিহীনতার শিকার এবং এ অপুষ্টি বিভিন্ন মাত্রার আমিষ, ক্যালরি, ভিটামিন এবং খণিজ পদার্থের অভাবজনিত কারণে হয়ে থাকে। বিপুল জনগোষ্ঠীর আমিষ ও ক্যালরির ঘাটতি পূরণ এবং অপুষ্টি দূরীকরণে সয়াবিন গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ সারাবিশ্বে সয়াবিন তেল ফসল হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হলেও পুষ্টির সর্বোৎকৃষ্ট উৎস সয়াবিনে অত্যাবশ্যকীয় নয়টি এমাইনো এসিড সমৃদ্ধ উচ্চমানের ৪০-৪৪% আমিষ, ২৪-২৬% কার্বোহাইড্রেট ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ ১৮-২২% তেল বিদ্যমান। এছাড়াও বিভিন্ন খনিজ পদার্থ যথা ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ফসফরাস এবং ভিটামিন-এ, বি, সি, ডি ও ই এর উৎস। সয়াবিনে মানবদেহের মস্তিষ্ক বৃৃদ্ধিতে সহায়ক লেসিথিন এবং হৃদরোগ প্রতিরোধসহ রক্তনালীতে প্লাক তৈরিতে বাধাদানকারী ও ক্যান্সার প্রতিরোধী আইসোফ্লভেনস্ বিদ্যমান। সয়াবিনে বিদ্যমান দ্রবণীয় এবং অদ্রবনীয় ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন দূরীকরণেও ভূমিকা রাখে।
তাই উল্লিখিত পুষ্টিমানের বিবেচনায় এবং দেশের অপুষ্টি দূরীকরণে প্রয়োজন দেশে সয়াবিনের উৎপাদন বৃদ্ধিতে চাষের জমির পরিমাণ বৃদ্ধিসহ উচ্চফলনশীল সয়াবিনের জাত চাষ করা।
বিনা উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল বিনা সয়াবিন৭ জাতটি চলতি ২০২২ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড (এনএসবি) কর্তৃক দেশের সয়াবিন চাষাধীন এলাকায় চাষাবাদের জন্য নিবন্ধিত হয়।
জাতটির বৈশিষ্ট্য: গাছ উচ্চতায় মাঝারি (৫০-৫৮ সেমি.), প্রাথমিক শাখার সংখ্যা ৪-৫টি, পাতা অন্যান্য জাতের তুলনায় গাঢ় সবুজ, প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ৪৫-৬০টি, ১০০০ বীজের ওজন ১২-১৪ গ্রাম এবং বীজের রঙ উজ্জ্বল ক্রিম রঙের ও অন্যান্য জাতের বীজের তুলনায় উজ্জ্বল, বরি মৌসুমে জীবনকাল ১০৫-১১০ দিন এবং খরিফ-২ মৌসুমে ৯৫-১০০ দিন, প্রতি হেক্টরে গড় ফলন ২.৬৫ টন এবং সর্বোচ্চ ফলন ৩.২০ টন। এছাড়াও জাতটি ভাইরাসজনিত হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগ সহনশীল এবং পোকার আক্রমণ কম।
জমি নির্বাচন ও তৈরি
এ দেশের মাটি এবং আবহাওয়ায় সয়াবিন রবি ও খরিফ-২ মৌসুমে চাষ করা যায়। বেলে দো-আঁশ হতে দো-আঁশ মাটি সয়াবিন চাষের জন্য বেশি উপযোগী। খরিফ-২ অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমের জন্য নির্বাচিত জমি অবশ্যই উঁচু ও পানি নিষ্কাশনযোগ্য হতে হবে। রবি মৌসুমে মাঝারি থেকে নিচু জমিতেও চাষ করা যায়। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, যশোর, রংপুর এবং ময়মনসিংহ অঞ্চল সয়াবিন চাষের জন্য উপযোগী।
মাটির প্রকারভেদে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে এবং আগাছামুক্ত করে বীজ বপন করতে হবে। মই দিয়ে জমি সমান করার পর সুবিধামতো আকারে প্লট তৈরি করে নিলে সেচ প্রয়োগ, পানি নিষ্কাশন ও অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
বপনের সময় ও বীজের হার
রবি মৌসুমে পৌষের প্রথম থেকে মাঘ মাসের মাঝামাঝি (ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির শেষ) পর্যন্ত এবং খরিফ-২ মৌসুমে মধ্য আষাঢ় থেকে মধ্য ভাদ্র (জুলাইয়ের প্রথম থেকে আগষ্টের শেষ) পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
সারিতে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ৫৫ কেজি (একর প্রতি ২২ কেজি) এবং ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ৬০ কেজি (একর প্রতি ২৪ কেজি) বীজ প্রয়োজন।
বপন পদ্ধতি
সয়াবিন বীজ সারিতে বপন করা উত্তম, তবে ছিটিয়েও বপন করা যায়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব রবি মৌসুমে ৩০ সেমি. বা ১২ ইঞ্চি দিতে হবে এবং খরিফ-২ মৌসুমে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩৫ সেমি. বা ১৪ ইঞ্চি দিতে হবে। সারিতে ১.০ - ২.০ ইঞ্চি গভীরে বীজ বপন করতে হবে। রবি মৌসুমে ছিটিয়ে বপন করলে চাষের পর বীজ ছিটিয়ে মই দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। খরিফ-২ মৌসুমে মাটি কাদাযুক্ত হলে বীজ ছিটিয়ে দিলেই হবে।
সারের মাত্রা ও প্রয়োগ
বাংলাদেশে কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা কম-বেশি হতে পারে। সাধারণভাবে অনুমোদিত সারের মাত্রা সারণি দ্রষ্টব্য।
সারণি : অনুমোদিত সারের মাত্রা (কেজি/হেক্টর)
জমিতে পচা গোবর অথবা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করলে রাসায়নিক সার কম লাগবে। রাসায়নিক সার শেষ চাষের আগে জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে পরে মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।
জীবাণুসার প্রয়োগ ও ব্যবহার পদ্ধতি
সয়াবিন গাছ রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে গাছের শিকড়ে জমা করতে পারে। বপনের পূর্বে বীজে জীবাণুসার মিশিয়ে বপন করলে গাছের শিকড়ে নডিউল বা গুঁটি সহজে সৃষ্টি হয়। শিকড়ে সৃষ্ট গুঁটি থেকে গাছ নাইট্রোজেন পায়। উল্লেখ্য, জীবাণুসার প্রয়োগ করা হলে সাধারণত ইউরিয়া সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না।
একটি পাত্রে এক কেজি পরিমাণ বীজ নিয়ে পরিষ্কার পানিতে হাত ভিজিয়ে ভিজা হাতে সয়াবিন বীজ নাড়াচাড়া করতে হবে, যাতে সকল বীজের উপরিভাগ ভিজে যায়। এক কেজি সয়াবিন বীজে ২০-৩০ গ্রাম চিটাগুড় বা ভাতের ঠা-া মাড় ভালোভাবে মেশানোর পর ৫০ গ্রাম জীবাণুসার মিশিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে যাতে চিটাগুড় মিশ্রিত আঠালো বীজের গায়ে জীবাণুসার সমভাবে লেগে যায়। জীবাণুসার মেশানোর পর বীজ তাড়াতাড়ি বপন করতে হবে, কারণ জীবাণুসার পাউডার মেশানোর পর বীজ অনেকক্ষণ ফেলে রাখলে জীবাণুসারের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।
আন্তঃপরিচর্যা
চারা গজানোর ১৫-২০ দিনের মধ্যে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। গাছ খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে। চারার বয়স ৩০-৩৫ দিন হওয়ার মধ্যেই নিড়ানি অথবা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আগাছা দমনের ব্যবস্থা করতে হবে। রবি মৌসুমে গাছে ফুলধরা এবং ফল বা শুঁটি ধরার সময় সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হতে পারে। বৃষ্টি না হলে প্রথম সেচ বীজ গজানোর ২০-৩০ দিন পর এবং দ্বিতীয় সেচ বীজ গজানোর ৫০-৫৫ দিন পর দিতে হবে। খরিফ-২ মৌসুমে সাধারণত এ ফসলের জন্য কোন সেচের প্রয়োজন হয় না, বরং জমিতে পানি জমে গেলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বালাই দমন ব্যবস্থাপনা
উচ্চফলনশীল বিনা সয়াবিন৭ ও সয়াবিন চাষাবাদে বিছাপোকা, কা-ের মাছি পোকা, কা- পচা রোগ, হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগ প্রভৃতি বালাই আক্রমণ হতে পারে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দমন করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণ
পরিপক্ব অবস্থায় সয়াবিন গাছ শুঁটিসহ হলুদ হয়ে আসলে এবং পাতা ঝরে গেলে মাটির উপর হতে কেটে সংগ্রহ করতে হবে। শুঁটিসহ গাছ রোদে ৩-৪ দিন ভালভাবে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ আলাদা করতে হবে। পরবর্তীতে ভালো করে শুকিয়ে ঠা-া করে বীজ গুদামজাত করতে হবে। উল্লেখ্য, সংরক্ষণের ২-৩ মাস পরই বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কমতে শুরু করে। তাই পরবর্তী মৌসুমে ব্যবহারের জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে হলে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে:
মাড়াই করার পর বীজ বিশেষ যত্নসহকারে শুকাতে হবে। যদি রোদের উত্তাপ খুব প্রখর হয় তবে বীজ একটানা তিন থেকে চার ঘণ্টার বেশি রোদে শুকানো ঠিক নয়। কারণ কড়া রোদে অনেকক্ষণ ধরে বীজ শুকালে অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সয়াবিন বীজ সরাসরি সিমেন্টের তৈরি পাকা খোলায় না শুকিয়ে ত্রিপল বা চাটাইয়ের উপর শুকাতে হবে। বীজ এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে বীজের আর্দ্রতা ৯% এর বেশি না থাকে। শুকানো বীজ দাঁত দিয়ে কামড় দিলে ‘কট’ শব্দ করে বীজ ভেঙে গেলে বুঝতে হবে যে বীজ ভালভাবে শুকিয়েছে।
শুকানোর পর বীজ ভালোভাবে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং রোগাক্রান্ত পচা বীজ বেছে ফেলে দিতে হবে।
বীজ সংরক্ষণের পূর্বে এর অংকুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
বীজ রাখার জন্য বায়োরোধী মোটা পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক বা টিনের ড্রাম, আলকাতরা মাখা মাটির মটকা বা কলসী, বিস্কুটের টিন ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মোটা পলিথিনের ব্যাগে বীজ রেখে মুখ শক্ত করে বেঁধে নিয়ে তা আবার একটি প্লাস্টিক বা চটের বস্তায় ভরে রাখলে ভালো হয়। তবে যে পাত্রই হোক প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মুখ ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে যেন কোনভাবেই ভেতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। উল্লেখ্য, বীজ শুকানোর পর গরম অবস্থায় সংরক্ষণ না করে ঠা-া হলে সংরক্ষণ করতে হবে।
লেখক : পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ-২২০২, মোবাইল: ০১৭১২-১০৬৬২০, ই-মেইল: malekbina@gmail.com